শুভ জন্মদিন,কবি!
সেই বাসন্তী রঙের পঁচিশে বৈশাখ আবার এসে পড়লো,দ্যাখো!কেমন আছো,তুমি? আমার কথা ভাবছিলে?
নাঃ! কেন বা ভাববে বল?হয়তঃ তুমি রাগ করবে চিঠি পেয়ে খানিক;মনে করবে,এতদিনে সময় হল?মনে করবে,জন্মদিনের তারিখ দেখে চিঠি লিখতে বসেছি আয়োজন করে... কথা তো হয়েছিল রোজ কথা হবে... দৈনন্দিনে জড়িয়ে থাকবো তোমাকে... যোগাযোগ হবে অবিচ্ছিন্ন,অক্লান্ত,অনাবিল...
কথা আমি রাখি নি বটে;রাগ তুমি করতেই পারো।ব্যাখ্যা করতে গেলে কথায় কথায় দু’পাতার চিঠি দশ পাতার হবে শুধু,তা ছাড়া আর হবে না কিছুই... তাই দোষ বরং স্বীকার করে নিই মাথা নিচু করে... আগে যেমন করে লিখতাম,সেভাবে আর সত্যিই তোমায় লেখা হয় না...
মনে আছে,তোমায় যে দিন প্রথম চিঠি লিখেছিলাম?সে দিন এমনই কোনো এক পঁচিশে বৈশাখ...রজনীগন্ধার পেলব ছোঁয়ায় সন্ধ্যেটায় মিশে গেছিল এক আশ্চর্য্য স্নিগ্ধতা... মনে আছে? লিখেছিলাম,
“ ওগো বাঁশিওআলা,
বাজাও তোমার বাঁশি,
শুনি আমার নূতন নাম”
— এই বলে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখেছি,মনে আছে তো ?
আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে ।
সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় দেন নি
আমাকে মানুষ করে গড়তে—
রেখেছেন আধাআধি করে ।
অন্তরে বাহিরে মিল হয় নি
সেকালে আর আজকের কালে,
মিল হয় নি ব্যথায় আর বুদ্ধিতে,
মিল হয় নি শক্তিতে আর ইচ্ছায় ।
আমাকে তুলে দেন নি এ যুগের পারানি নৌকোয়,
চলা আটক করে ফেলে রেখেছেন
কালস্রোতের ও পারে বালুডাঙায় ।
সেখান থেকে দেখি
প্রখর আলোয় ঝাপসা দূরের জগৎ —
বিনা কারণে কাঙাল মন অধীর হয়ে ওঠে,
দুই হাত বাড়িয়ে দিই,
নাগাল পাই নে কিছুই কোনো দিকে ।
বেলা তো কাটে না,
বসে থাকি জোয়ার-জলের দিকে চেয়ে—
ভেসে যায় মুক্তি-পারের খেয়া,
ভেসে যায় ধনপতির ডিঙা,
ভেসে যায় চল্তি বেলার আলোছায়া ।
সেই স্নিগ্ধ,পেলব সাঁঝে তোমার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল,বরং তোমার নাম দিই আমার নির্ভরতা; তোমার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল আমার অযথা ক্লান্ত দিনপাতের এই বুঝি ‘শেষ পরিপূর্ণতা’...আমার ‘আলোর ভুবন’...ধীরে ধীরে একটি একটি করে দরজা খুলে ফেললে সেই ভুবনে আশ্রয় দেবে তুমি...মনে পড়ে,তুমি একবার লিখেছিলে চিঠির উত্তরে,“প্রথার সঙ্গে বুদ্ধির,বুদ্ধির সঙ্গে ইচ্ছার,ইচ্ছার সঙ্গে কাজের কোনোরকম অহর্নিশ খিটিমিটি না ঘটে যেন...” আর আমার? আমার তো জন্মেও ‘মিল হয় নি ব্যথায় আর বুদ্ধিতে,মিল হয় নি শক্তিতে আর ইচ্ছায়...’ তাই আমার চিরকাল মাথা নিচু তোমার কাছে,চিরকাল হাতে ভিক্ষাপাত্র,চিরকাল নিলাজ,অসহায় চিত্কার “চাই! চাই!” “দাও! দাও!”... ...আর কাকে বলবো বল? কার কাছে রাখবো দাবী? তোমার সাথেই তো আমার সখ্য,কবি... তোমার কাছেই তো আমার আবদার... তোমায় আমি বর্ম করে রাখি মনের গলিঘুঁজি’তে সর্বনাশ ঘটার মূহুর্তে,তোমায় আমি আঁকড়ে ধরি মনের চোরাঘুর্ণি’তে তলিয়ে যাবার আগে...তোমায় ভালোবাসি বিহ্বল হয়ে; রঙরঙিন, ভাষ্যহীন সে ভালোবাসা...
এমন সময় বাজে তোমার বাঁশি
ভরা জীবনের সুরে ।
মরা দিনের নাড়ীর মধ্যে
দব্দবিয়ে ফিরে আসে প্রাণের বেগ ।
কী বাজাও তুমি ,
জানি নে সে সুর জাগায় কার মনে কী ব্যথা ।
বুঝি বাজাও পঞ্চমরাগে
দক্ষিণ হাওয়ার নবযৌবনের ভাটিয়ারি ।
শুনতে শুনতে নিজেকে মনে হয় —
যে ছিল পাহাড়তলির ঝির্ঝিরে নদী ,
তার বুকে হঠাৎ উঠেছে ঘনিয়ে
শ্রাবণের বাদলরাত্রি ।
সকালে উঠে দেখা যায় পাড়ি গেছে ভেসে ,
একগুঁয়ে পাথরগুলোকে ঠেলা দিচ্ছে
অসহ্য স্রোতের ঘূর্ণি-মাতন ।
আমার রক্তে নিয়ে আসে তোমার সুর—
ঝড়ের ডাক,বন্যার ডাক,আগুনের ডাক,
পাঁজরের উপরে আছাড়-খাওয়া
মরণ-সাগরের ডাক,
ঘরের শিকল-নাড়া উদাসী হাওয়ার ডাক ।
যেন হাঁক দিয়ে আসে
অপূর্ণের সংকীর্ণ খাদে
পূর্ণ স্রোতের ডাকাতি,
ছিনিয়ে নেবে,ভাসিয়ে দেবে বুঝি ।
অঙ্গে অঙ্গে পাক দিয়ে ওঠে
কালবৈশাখীর ঘূর্ণি-মার-খাওয়া
অরণ্যের বকুনি ।
ডানা দেয় নি বিধাতা,
তোমার গান দিয়েছে আমার স্বপ্নে
ঝোড়ো আকাশে উড়ো প্রাণের পাগলামি ।
তোমার চিঠি মনে পড়ে সে সব পাগলামির মূহর্তগুলোয়। মনে পড়ে,তুমি লিখেছিলে একখানি চিঠি’তে,“একবার যদি এই রুদ্ধ জীবনকে খুব উদ্দাম,উচ্ছৃঙ্খলভাবে ছাড়া দিতে পারতুম, একেবারে দিগ্বিদিকে ঢেউ খেলিয়ে ঝড় বইয়ে দিতুম...”তারপরেই আবার মন খারাপ করে লিখেছিলে,“কিন্তু আমি বেদুইন নই। বাঙালী।”
আমারও হয়েছে সেই দশা,জানো তো!উত্তেজনার পারদে যত আঁচ লাগে তোমার সুরের, তোমার কথার,তত যেন আকাশজোড়া ধূসর বিষাদ চেপে ধরে আমাকে। উন্মনা সমস্ত কল্পনা শেষমেষ বালিশে গুমরে মরে। আমি যে বড় সাধারণ বাঙালী মেয়ে,কবি...
ঘরে কাজ করি শান্ত হয়ে ;
সবাই বলে ‘ভালো' ।
তারা দেখে আমার ইচ্ছার নেই জোর ,
সাড়া নেই লোভের ,
ঝাপট লাগে মাথার উপর ,
ধুলোয় লুটোই মাথা ।
দুরন্ত ঠেলায় নিষেধের পাহারা কাত করে ফেলি
নেই এমন বুকের পাটা ;
কঠিন করে জানি নে ভালোবাসতে ,
কাঁদতে শুধু জানি ,
জানি এলিয়ে পড়তে পায়ে ।
আমি যে এরকমই।মনখারাপিয়া মেয়ে।বিষন্নতাতেই সুখ আমার সবাই বলে।মনে পড়ে সেইবার কবি? সেই যে একজনের কথা লিখেছিলাম তোমায়? সে কখনো উজ্জ্বল,কখনো স্নিগ্ধ, কখনো বাউল,কখনো উদাস- আমি হলাম পাগল আর সে হল আমার পাগলামি।তারপর... তারপর কোথা থেকে কি হল... ঝড় উঠল ভীষণ- নিদারুন,নৃশংস,কালবৈশাখী – আমার ‘আলোর বাসা’ ধূলিসাৎ করে বিদেয় হল সে- তখন আমার কান্না থামাতে পারেনি কেউ- তুমি এলে,হাত ধরে বসলে পাশে,চিঠি’তে গান দিয়ে হাতের মুঠোয় দিলে গুঁজে-
... ... যদি আর কারে ভালোবাসো,যদি আর ফিরে নাহি আসো
তবে তুমি যাহা চাও,তাই যেন পাও
আমি যত দুখ পাই গো...
আমার পরাণ যাহা চায়,
তুমি তাই,তুমি তাই গো... ...
তুমি আমার উত্তরণ,কবি; তুমি আমার প্রিয়তম সখা। এ সখ্যতা কি আজকের,বলো? মানছি, তোমার ভিজে চোখের পাতার দিকে আমি মন দিয়ে চাইনি কখনো। তোমাকে ‘ঈশ্বর’ ভেবে প্রার্থনার ফিরিস্তি শুনিয়েছি আজন্মকাল। জানি তুমি রাগ করে আছো,খারাপ লেগেছে তোমার- ভেবেছ কি স্বার্থপর আমি! কি ভীষণ নির্লজ্জ! তবু সত্যি কথা কি বলতো? তুমি যদি চিঠির জবাব না দাও রাগ করে,যদি সত্যি সত্যি দূরে ঠেলে দিতে চাও আমায়,তুমি আমার কাছ থেকে কিন্তু কাড়তে পারবে না কিচ্ছু। কেউ পারবেনা তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে। তুমি কাছে থাকলে সে আমার আনন্দ বসন্ত -তুমি দূরে থাকলে সে আমার বেদনার নিদাঘ- তবু সে তুমিই- তুমি নানা রূপে!
আলো-অন্ধকারে তোমাকেই চিরকাল দেখেছি...ভেবেছি,
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারা রাত ফোটাক তারা নব নব...
তোমায় গিয়ে মেশে আমার বিশ্বাস আর আলো-আঁধারি... তোমায় গিয়ে এক হয়ে যায় আমার চাওয়া আর পাওয়া... আচ্ছা,তোমার কখনো মনে হয়,এত ভালোবাসার জন্য বোধ হয় একটু আবডাল ভালো?
বাঁশিওআলা ,
হয়তো আমাকে দেখতে চেয়েছ তুমি ।
জানি নে ঠিক জায়গাটি কোথায়,
ঠিক সময় কখন,
চিনবে কেমন করে ।
দোসর-হারা আষাঢ়ের ঝিল্লিঝনক রাত্রে
সেই নারী তো ছায়ারূপে
গেছে তোমার অভিসারে চোখ-এড়ানো পথে ।
সেই অজানাকে কত বসন্তে
পরিয়েছ ছন্দের মালা ,
শুকোবে না তার ফুল ।
তোমার ডাক শুনে একদিন
ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে
অন্ধকার কোণ থেকে
বেরিয়ে এল ঘোমটা-খসা নারী ।
যেন সে হঠাৎ-গাওয়া নতুন ছন্দ বাল্মীকির ,
চমক লাগালো তোমাকেই ।
সে নামবে না গানের আসন থেকে ;
সে লিখবে তোমাকে চিঠি
রাগিণীর আবছায়ায় বসে ।
তুমি জানবে না তার ঠিকানা ।
ওগো বাঁশিওআলা ,
সে থাক্ তোমার বাঁশির সুরের দূরত্বে ।